প্রেম ও দ্রোহের কবি ও সাংবাদিক হেলাল হাফিজ আর নেই

0
5

নিজস্ব প্রতিবেদক

  • প্রকাশ: ডিসেম্বর ১৩, ২০২৪

ছবি: সংগৃহীত

প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ আর নেই। শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

সাংবাদিক ও কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

হেলাল হাফিজ দীর্ঘদিন ধরে গ্লুকোমায় আক্রান্ত ছিলেন। পাশাপাশি কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস ও স্নায়ু জটিলতায় ভুগছিলেন।

হেলাল হাফিজের মৃত্যুর বিষয়টি সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা শবনম ফেরদৌসী।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া জানান, শাহবাগের সুপার হোম হোস্টেল থেকে তাকে অজ্ঞান অবস্থান উদ্ধার করে হাসপাতালে (বিএসএমএমইইউ) নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তিনি বহু আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

কবির ভাতিজি রিনি জানান, সন্ধ্যা ৬টার দিকে পিজি হাসপাতাল থেকে কবি হেলাল হাফিজের মরদেহ গোসলের জন্য মোহাম্মদপুর তাকওয়া মসজিদে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে এনে পুনরায় তার মরদেহ পিজি হাসপাতালে রাখা হবে।

কবি হেলাল হাফিজের বড় ভাই দুলাল হাফিজ জানান, কবির প্রথম জানাজা শনিবার সকাল ১১টায় বাংলা একাডেমিতে এবং বাদ যোহর জাতীয় প্রেসক্লাবে দ্বিতীয় জানাজা শেষে নেত্রকোনায় নিয়ে যাওয়া হবে। পরে তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

হেলাল হাফিজকে কোথায় সমাহিত করা হবে এ বিষয়ে মৃত্যুর আগে কবি কিছু বলে গেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, মৃত্যুর পর কোথায় রাখা হবে তা কখনো তিনি বলতেন না। তার আসলে আর কখনো ঘরে ফেরাই হলো না।

সুপার হোম হোস্টেলের ম্যানেজার জায়েদ আল সাবিত বলেন, আমার সঙ্গে আজ সর্বশেষ দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে কথা হয়। বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। রক্তাক্ত অবস্থায় আনুমানিক ২টা ১০মিনিটের দিকে বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে তাকে পিজি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে পৌঁছানোর পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্ম গ্রহণ করেন।

১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ দিয়েই মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন হেলাল হাফিজ। এ কাব্যগ্রন্থভুক্ত প্রতিটি কবিতার শেষে উল্লেখিত তারিখ অনুযায়ী কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে হেলাল হাফিজ পাঠক মনে যে নাড়া দিয়েছেন, তা এখনও ইতিহাস হয়ে আছে। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থটির এখন পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি সংস্করণ হয়েছে। যা এর আগে বাংলাদেশের কোনো কবিতার বইয়ের বেলায় ঘটেনি। এই কবিতার বইয়ের পাঠকের সংখ্যা যে অগণিত, তা বলাই বাহুল্য।

‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থই হেলাল হাফিজকে দিয়েছে অসামান্য খ্যাতি। এরপর দীর্ঘদিন আর কোনো বই বের করেননি তিনি। ২০১২ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে প্রকাশ করা হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় কবিতার বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। কবিতার জন্য ২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।

এত কম কবিতা লিখে এত খ্যাতি পাওয়ার নজির বাংলাদেশের সাহিত্যে নেই।

১৯৬৫ সালে হেলাল হাফিজ নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ওই বছরই কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক ‘পূর্বদেশে’ সাংবাদিকতা শুরু করেন।

১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।

কবিতায় অসামান্য অবদানের স্মারক হিসেবে হেলাল হাফিজকে ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়াও তিনি পেয়েছেন- যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা।

কবি হেলাল হাফিজের লেখালেখির সূচনা ঘটে ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। সাংবাদিকতা করার দরুণ কবি ওই সময়ের উত্তাল পরিবেশের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলেন।

এক শোক বার্তায় মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যু বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।

প্রধান উপদেষ্টা কবির পরকালীন জীবনের শান্তি কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

তিনি বলেন, কবি হেলাল হাফিজ ছিলেন তারুণ্যের শক্তি এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সাহসী কণ্ঠ। তাঁর কালজয়ী কবিতার মতোই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে।

কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে