ঘটনাবহুল মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস। ট্রাম্প আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। আর কমলা বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট। জো বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ালে সুযোগ পান কমলা। বিভিন্ন জরিপ বলছে তিনি এগিয়ে আছেন ট্রাম্পের চেয়ে। জরিপের ফলাফল মতে, কমলা হতে যাচ্ছেন প্রথম মার্কিন নারী প্রেসিডেন্ট। যদিও লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার কোনো বাসনা ট্রাম্পের নেই। সর্বশেষ নির্বাচনের মতো তার হার সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে বলেও মনে করা হচ্ছে। জেতার জন্য নানা পদ্ধতি অবলম্বন করছেন ট্রাম্প। অক্টোবরের প্রথম দুই সপ্তাহে, তিনি এবং তার সহযোগীরা সম্প্রচারিত টিভি বিজ্ঞাপনে তাদের ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খরচ করেছেন ট্রান্সজেন্ডার স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের জন্য। যা আগের মাসের বিজ্ঞাপন ব্যয় থেকে একটি বড় কৌশলগত পরিবর্তন। অন্যদিকে কমলা হ্যারিস এবং তার সহযোগীরা কর এবং স্বাস্থ্যসেবার ওপর করা বিজ্ঞাপনে অর্থ ব্যয় বেশি করেছেন। এর আগে গর্ভপাতের অধিকারের বিষয়ে তাদের বিনিয়োগ ছিল বেশি। জুলাইয়ের শেষ দিকে পতিযোগিতায় প্রবেশ করার পর থেকে হ্যারিস গড় ভোটে ট্রাম্পের চেয়ে অল্প ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। বিবিসি বলছে, হ্যারিস তার প্রচারণার প্রথম কয়েক সপ্তাহে ভোটের সংখ্যায় একটি উল্লম্ফন দেখেছিলেন, আগস্টের শেষ দিকে প্রায় চার শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন তিনি। ১০ সেপ্টেম্বর দুই প্রার্থীর মধ্যে বিতর্কের পরও কমলা এগিয়ে ছিলেন। বিবিসি আরও বলছে, এ জাতীয় জরিপ সমগ্র দেশে একজন প্রার্থী কতটা জনপ্রিয় তার জন্য একটি দরকারি নির্দেশিকা, তবে নির্বাচনী ফলাফলের ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য এটি একটি সঠিক উপায় নয়। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রতিটি রাজ্যকে তার জনসংখ্যার আকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেশ কয়েকটি ভোট দেওয়া হয়। মোট ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট রয়েছে, তাই একজন প্রার্থীকে জিততে ২৭০ ছুঁতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি রাজ্য রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ রাজ্যের ভোটার প্রায় সবসময় একই দলকে ভোট দেয়। আর কিছু রাজ্য সুইং স্টেট হিসেবে পরিচিত।
বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াইয়ে শামিল হন কমলা হ্যারিস। তার প্রচার উদারপন্থি ভোটারদের পুনরুজ্জীবিত করেছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হ্যারিসের প্রচার তহবিলে জমা পড়েছে ৬৭.১ কোটি ডলার অনুদান, যা তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংগ্রহের প্রায় তিনগুণ। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর এই দৌড়ে হ্যারিসের রয়েছে ঘটনাবহুল ও বর্ণিল একটি সফর। কমলা হ্যারিস ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে অভিবাসী যুগলের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং বাবা জ্যামাইকান আমেরিকান। কমলার যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। তারপর মূলত মা শ্যামলা গোপালন হ্যারিসের কাছেই বড় হন তিনি। হ্যারিস জানিয়েছেন, তাকে এবং তার ছোট বোন মায়াকে ওকল্যান্ডের কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় করে তুলেছিলেন তার মা। যিনি একজন ক্যানসার গবেষক এবং নাগরিক অধিকারকর্মী ছিলেন। তার আত্মজীবনী ‘দ্য ট্রুথস উই হোল্ড’-এ কমলা লিখেছেন, আমার মা খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি দুজন কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে লালন-পালন করছেন। তিনি জানতেন যে তার নতুন দেশ মায়া এবং আমাকে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে হিসেবে দেখবে এবং আমরা যাতে আত্মবিশ্বাসী, গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী হয়ে উঠি তা নিশ্চিত করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। শ্যামলা গোপালন হ্যারিস ভারতীয় ছিলেন। তার আদি বাড়ি ভারতের তামিলনাড়ুতে। ১৯৫৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। কমালা হ্যারিসের স্বামী আইনজীবী ডাগ এমহফ। তাদের দেখা হয় ব্লাইন্ড ডেটে আলাপে। ২০১৪ সালে এই যুগল বিয়ে করেন। ডাগ এমহফের সন্তান কোল এবং এলা মিজ হ্যারিসকে মোমালা বলে ডাকে। তার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কমলা হ্যারিস এলি ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন, রবিবারের নৈশভোজ আমাদের কাছে পারিবারিক সময়। কোল টেবিল সেট করে এবং সংগীত বাছাই করে। এলা ডেজার্ট (মিষ্টান্ন) তৈরি করে, ডাগ আমার স্যুস-শেফ হিসেবে কাজ করে এবং আমি রান্না করি। ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যে শীর্ষ আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন হ্যারিস। তিনি প্রথম নারী এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব যিনি এ পদে ছিলেন। তার এ সাফল্য ২০১৬ সালের ক্যালিফোর্নিয়ার সেনেটর নির্বাচনের প্রচারে গতি আনে এবং তার বিজয় নিশ্চিত করে। এরপর ২০২০ সালে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হওয়ার জন্য প্রচার চালান। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়েই সেই দৌড় থেকে বেরিয়ে যান তিনি। তারপর এখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে লড়ছেন তিনি।
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জো বাইডেন থাকা অবস্থায় সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণার পর আরও সক্রিয় হন নির্বাচনে। জনসংযোগের পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহেও তার চনমনে ভাব দেখা যায়। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, প্রচারের শুরুতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তহবিল সংগ্রহে ট্রাম্পের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন বলে মনে করা হচ্ছিল। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩৪টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তার তহবিল সংগ্রহও বেড়ে গেছে। বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত ট্রাম্প এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে মামলায় রায় ঘোষণার পরপরই অনুদানের টাকার পরিমাণ হু হু করে বেড়ে যায়। ট্রাম্প তার পথে যে রাজনীতি করবেন সে বিষয়টি পরিষ্কার। তাকে যারা বিভিন্ন সময়ে অনুদান দিয়ে আসছেন, তারা ট্রাম্পের মতো বিতর্কিত বলে মন্তব্য করেছেন। তারা হোয়াইট সুপ্রিমেসিরই অংশ। ট্রাম্পের সঙ্গে তাদের সখ্য ব্যবসাসহ পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে বলে অনুমান। ট্রাম্পের আগের শাসনেও যা দেখা গেছে। যা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কারণ তহবিল যারা দিচ্ছেন রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অংশগ্রহণ থাকে। এতে ভোটারের গুরুত্ব কমে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন নির্বাচনে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য প্রকাশ্যে ‘আর্থিক কারসাজির’ কিছু ঘটনা ঘটে। তবে এর বাইরেও অবশ্যই ‘অবৈধ অর্থে’র ব্যবসাও রয়েছে, যা ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক। যা রাজনৈতিক ফলাফলকে প্রভাবিত করার জন্য ব্যয় হয় আর এসব অর্থের উৎসও প্রকাশ করা হয় না। বিবিসি বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিচিতি এবং ‘অপরিশোধিত’ নির্বাচনী প্রচারশৈলী তাকে অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের ভোটে হারিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কার্যকালে বিতর্কও কম হয়নি। মাত্র একদফাই ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। ৭৮ বছরের এই রিপাবলিকান আবারও সমস্ত ‘প্রতিকূলতা’ উপেক্ষা করে ‘অত্যাশ্চর্য’ রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ঘটাতে চাচ্ছেন যা তাকে ওভাল অফিসের প্রেসিডেন্টের ডেস্কে ফিরিয়েও নিয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে তহবিল সংগ্রহ একটি ফ্যাক্টর। যাতে এগিয়ে আছেন কমলা হ্যারিস। এরপর আরও কিছু ফ্যাক্টর কাজে লাগে। এর একটি হচ্ছে ইহুদি ভোট। তবে হামাস নেতা সিনওয়ারকে হত্যার পর কমলা হ্যারিসের ইহুদি ভোট নিয়ে সংশয় অনেকটা কেটে যাওয়ার কথা। এরপর রয়েছে বামপন্থিরা। যারা কখনো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিতে চাইবেন না। তারা অবশ্য জো বাইডেনকেও ভোট দিতে চাননি। কিন্তু কমলা হ্যারিস নির্বাচনে দাঁড়ানোয় এখন সুযোগ তৈরি হয়েছে তাদের ভোট পাওয়ার। যদিও বামপন্থিরা গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধে ডেমোক্র্যাট তথা মার্কিন সরকারের ভূমিকা আশা করেছিলেন। কিন্তু সেটা হয়নি। ফলে অনেক বাম হয়তো ভোটদানে বিরত থাকবেন। আর যারা দেবেন তারা কমলাকেই দেবেন।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে তারকাদেরও ফ্যাক্টর হিসেবে ধরা হয়। যেমন টেইলর সুইফট। বিপুল জনপ্রিয় এ শিল্পী যাকে ভোট দেবেন, ভক্তরা স্বাভাবিকভাবে তাকে ভোট দেবেন। যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে টেইলর সুইফট কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন। তার এ ঘোষণার পর আলোচনা শুরু হয়েছে ‘সুইফট ইফেক্ট’ নিয়ে। দ্য গার্ডিয়ানে লেখক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক রিচার্ড টি লনগোরিয়া লিখেছেন, কমলা হ্যারিসকে টেইলর সুইফটের সাম্প্রতিক সমর্থন কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে? এটা অবশ্যই হতে পারে। আমি বেশ কয়েক বছর ধরে আমেরিকান রাজনীতিতে সেলিব্রিটিদের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে আসছি। গবেষণায় দেখা যায়, বেশিরভাগ আমেরিকান ভোটারদের জন্য একটি সেলিব্রিটির অবস্থান কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন, সে বিষয়ে স্থির এবং খুব কম আমেরিকান এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। সাম্প্রতিক জরিপ থেকে জানা যায়, প্রায় ৫ শতাংশ আমেরিকান ট্রাম্প না কমলা কাকে ভোট দেবেন এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীন। যাই হোক, এই পাঁচ শতাংশ জয় এবং হারের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে। জরিপ দেখাচ্ছে, ট্রাম্প এবং কমলা প্রত্যেকে ৪৫ শতাংশ ভোট পাবেন। গবেষক বলছেন, গবেষণা এ পরামর্শ দেয় যে, প্রায় ১১ শতাংশ মার্কিন প্রাপ্তবয়স্ক তারকাদের দ্বারা প্ররোচিত হতে পারেন এবং প্রায় ১৯ শতাংশ তরুণও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন। অনিয়মিত বা নতুন ভোটারদের মধ্যে একজন তারকার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। যে লোকেরা নতুন করে রাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহী বা যারা সাধারণত তারকাদের নিয়ে গসিপের মতো বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাদের জন্য সুইফটের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
এ মুহূর্তে ট্রাম্প এবং কমলা উভয়েই সিদ্ধান্তহীন ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন, একই সঙ্গে তাদের মূল সমর্থকদের উৎসাহিত করছেন। তৃতীয় ফ্যাক্টর হচ্ছে অনুদান। এতেও কমলা শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আছেন। ফলে তার পক্ষেই যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।