ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ মাসুদ
- প্রকাশ: জানুয়ারি ৬, ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ ৫০ বছর আড়ালে থাকার পর রোববার (৫ জানুয়ারি) রাত ৯টায় প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের ইউটিউব চ্যানেলে লাইভ টকশোতে কথা বলেছেন প্রকাশ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম (বীর বিক্রম)।
বিশেষ ইউটিউব চ্যানেলের লাইভে মেজর ডালিমের বক্তব্য

বাংলাদেশে লাইভ টকশোর ইতিহাসে সকল রেকর্ড ভেঙে এক সাথে প্রায় ৮ লাখ দর্শক টকশোটি উপভোগ করেন। টকশোটি বাংলাদেশে এবং প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এর আগে পৃথিবীর কোনো লাইভে একসাথে এতো মানুষ যুক্ত থাকেনি। অর্থাৎ এটা বিশ্ব রেকর্ড।”
শরিফুল হক ডালিম, যিনি মেজর ডালিম নামেই বেশি পরিচিত। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন ।
অভিযোগ ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন।
আলোচনার টকশোর শুরুতেই সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমাদের জাতির সূর্যসন্তান যিনি ২০২৪ সালের আন্দোলন দেখেছেন,১৯৭৫ সালে জাতিকে সফলতা এনে দিয়েছিলেন।যে কারণে আপনাকে আমরা মেজর ডালিম হিসেবে ডাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আপনি জাতিকে এড্রেস করতে পারেন। টকশোর শুরুতে মেজর ডালিম বলেন, দেশবাসীকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছাত্র-জনতাকে, যারা আংশিক বিজয় অর্জন করেছেন, তাদের লাল শুভেচ্ছা জানাই। বিপ্লব একটি সমাজ যেকোনো রাষ্ট্রে একটি চলমান প্রক্রিয়া। তার জন্য আরও সময় প্রয়োজন। সম্পূর্ণ বিজয় উল্লেখ হয় নি উল্লেখ করে মি. ডালিম আরো বলেন, সম্পূর্ণ বিজয় এখনো আমাদের অর্জিত হয়নি। চলমান বিপ্লবের ধারায় সঙ্গ দিতে হবে। চতুর্থ রিপাবলিক মানে চতুর্থ বিপ্লবের কথা উল্লেখ করছি।
৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ জানতে চাইলে তিনি বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “শেখ মুজিব স্বৈরাচারী শাসন চালু করেছিলেন, যা সাধারণ মানুষকে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠতে বাধ্য করেছিল। তার স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটানো ছিল সময়ের দাবি।” ৭৫’ এর ১৫ই আগস্টে ঠিক কি হয়েছিল জানতে চাইলে মেজর ডালিম বলেন, খুবই স্পর্শকাতর প্রশ্ন। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা গল্প তুলে ধরেন তিনি। মেজর ডালিম বলেন, ‘শেখ মুজিব তার জুলুমের মাত্রা এতোটাই তীব্র করেছিল স্বৈরাচারী আচরণের মতো যে, তখন মানুষ রবের কাছে মুক্তি চাচ্ছিল তার জুলুমের অবসানের জন্য।’
নিজের ঢোল নিজে বাজানো যায় না। প্রথম কথা, ১৫ই আগস্ট কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। ১৫ আগস্ট একটি সামরিক বিপ্লব ছিল। এতে উভয় পক্ষের লোকজন হতাহত হয়। তবে বিপ্লবীরা বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এরপর লাখ লাখ মানুষ আনন্দ মিছিল করে, এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জনসমর্থন নিয়ে প্রকাশ্যে আসে। এর মাধ্যমে এই সামরিক অভ্যুত্থান জনসমর্থন লাভ করে।” আমরা বুঝতে পেরেছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা কাদের ইন্টারেস্টে হচ্ছে? এটা কি আমাদের ইন্টারেস্টের জন্য হচ্ছে যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করবো। নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করবো।
বীর বিক্রম বলেন, “যখন সাতদফাতে চুক্তি করে নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিনকে পারমিশন দেওয়া হলো একটা প্রভিশনাল গর্ভমেন্ট গঠন করার। সাতটা ক্লজ পড়ে সাইন করার পর নজরুল ইসলাম ফিট হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন, আমরা ক্রমান্বয়ে ভারতের একটা করদরাজ্য-অঙ্গরাজ্যে পরিণত হব।”
বীর বিক্রম লাইভে এসে বলেন, ‘মুজিব মারা যায়নি, একটি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছে। বাকশাল বিদায়ের পরে কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে এসে শুকরিয়া আদায় করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পরে দেশের মানুষ মিষ্টি বিতরণ করেছিল।’ এভাবেই জনস্বীকৃতি পেয়েছিল ১৫ আগস্টের বৈপ্লবিক সামরিক অভ্যুত্থান।”
তিনি বলেন, “তথাকথিত নেতারা যখন ভারত পালিয়ে গেল। ছিল না যখন কেউ নেতৃত্বের দেওয়ার। সমঝোতা নিয়ে সবাই ব্যস্ত। পাকিস্তান বাহিনী যখন বাঙালির উপর হামলে পড়েছিল। তখন মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা আসে। আমি তখন পাকিস্তান আর্মিতে। মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনে মনে হলো, আর বসে থাকার সময় নেই। আমরা তখনই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে গেলাম।”
জাতীয় সঙ্গীত ইস্যু: জাতীয় সঙ্গীত ইস্যুতে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের না হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম বা অন্যান্য স্বনামধন্য দেশীয় কবিদের গান হতে পারত। ভিনদেশী একজন কবির গানকে জাতীয় সঙ্গীত বানানোকে পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মুজিবের আত্মসমর্পণের দাবি: মুজিবের আত্মসমর্পণের দাবি ইস্যুতে মেজর ডালিম দাবি করেন, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে নিজে আত্মসমর্পণ করেন এবং তার পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব পাকিস্তানের হাতে তুলে দেন।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ইস্যুতে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লক্ষ নয়, বরং মাত্র ৩ লক্ষ।
নারীদের নির্যাতনের সংখ্যা ইস্যুতে : মেজর ডালিম দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের সংখ্যা ২ লক্ষ নয়, বরং অনেক কম। তিনি নিজে মাত্র দুইজন নির্যাতিত নারীর সাক্ষাৎ পান।
স্বাধীনতা ইস্যু : মেজর ডালিমের বক্তব্য অনুযায়ী শেখ মুজিব স্বাধীনতা চাইতেন না; বরং স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ছিলেন।
ভারতের ভূমিকা ইস্যু: ভারতের ভূমিকা ইস্যুতে এই বীর বিক্রম বলেন, ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিল কেবল তাদের প্রদেশে পরিণত করার উদ্দেশ্যে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়: মেজর ডালিমের বক্তব্যে উঠে আসে, ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে ভারতীয় বাহিনীর হাত ছিল।
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা ইস্যুতে : মেজর ডালিম বলেন, ‘মুজিব মারা যায়নি, একটি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছে। বাকশাল বিদায়ের পরে কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে এসে শুকরিয়া আদায় করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পরে দেশের মানুষ মিষ্টি বিতরণ করেছিল।’ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ইস্যুতে: মেজর ডালিমের মতে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মুজিব হত্যার সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এবং পরে বিপ্লবীদের দমন করেন। তিনি দাবি করেন, তিনি জিয়াউর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, মুজিবের ডাকে নয়।
অর্থনৈতিক লুটপাট ইস্যুতে: তার দাবি অনুযায়ী, ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ১৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়।
সিরাজ সিকদার হত্যা: মুজিব সরকার পরিকল্পিতভাবে বিপ্লবী সিরাজ সিকদারকে হত্যা করেছিল।
বিপ্লবের ধারাবাহিকতা ইস্যুতে: তিনি বলেন, চলমান আন্দোলন “চতুর্থ বিপ্লব” বা “চতুর্থ রিপাবলিক” এর অংশ।
২৪’এর গণঅভ্যুত্থানের নেপথ্যের নায়ক ছাত্র-জনতাকে পরামর্শ:
২৪’এর গণঅভ্যুত্থানের নেপথ্যের নায়ক ছাত্র-জনতাকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সম্প্রসারণবাদী-হিন্দুত্ববাদী ভারত যার কবজায় আমরা প্রায় চলে গিয়েছি। সেই অবস্থান থেকে সেই ৭১’এর মতো আরেকটা স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। তা না হলে বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
তিনি আরো বলেন, আমি এবং আমার সাথী ভাইয়েরা যারা এখনো বেঁচে আছি আমরা যদি আমাদের বর্তমান প্রজন্মের বিপ্লবী ছাত্র জনতাদের বিপ্লবী কর্মকান্ডে কোনরকম অবদান রাখতে পারি; আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা, যোগাযোগ থেকে তাহলে আমরা সেটা করতে প্রস্তুত।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে, যাতে তারা সঠিক ইতিহাস জানতে পারে।
তিনি বর্তমান প্রজন্মের বিপ্লবীদের উদ্দেশে বলেন, “তাদের প্রয়োজনে আমি আমার অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ দিতে প্রস্তুত। তারা যেন শক্তিশালী, সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে, সেই দোয়া করছি।”

মেজর শরিফুল হক ডালিম ও তার পরিবার। ছবি: সংগৃহীত