ভারত থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল সেটি বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দুটি কারণে প্রকল্পটি বাতিল হচ্ছে। প্রথমত-ভারতীয় গ্যাসের গুণগত মান নিম্নমানের। দ্বিতীয়ত-বিশেষ ক্ষমতা আইনে টেন্ডার ছাড়াই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ওই গ্যাস আমদানি করতে চেয়েছিল।
বর্তমান সরকার আইনটি স্থগিত করে এর আওতায় প্রাথমিক চুক্তি হওয়া অনেকগুলো প্রকল্প ইতিমধ্যে বাতিল করেছে। ফলে এলএনজি আমদানির জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আপাতত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের সম্ভাবনা নেই বলে সরকারি সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে বিদেশ থেকে জাহাজে এলএনজি আমদানি করছে বাংলাদেশ। পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে এলএনজি আমদানির জন্য ২০২১ সালের ১৬ জুন ভারতীয় কোম্পানি এইচ-এনার্জির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে পেট্রোবাংলা। এর আগে ২০১৭ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি একই উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেডের সঙ্গে প্রথম এমওইউ স্বাক্ষর করেছিল।
পাইপলাইন স্থাপন এবং এলএনজি সরবরাহ-সংক্রান্ত দুটি চুক্তি চলতি বছরেই সই হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারত নীতিগতভাবে একমত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের দুই বছরের মধ্যে কোম্পানিটি এলএনজি সরবরাহ করবে বলেও জানিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা আর হয়নি।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা শেষ সময়ে দেখলাম, ভারতীয় গ্যাসের গুণগত মান আমাদের দেশের চেয়ে নিম্নমানের। তাদের গ্যাসে সালফারের পরিমাণ বেশি। আবার হিটিং ভ্যালুও (দহন মান) কম। ফলে ওই গ্যাস আমাদের পাইপলাইনে আমরা অ্যালাও করব না। তা ছাড়া প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল বিশেষ ক্ষমতা আইনে। যে আইনটি ইতিমধ্যে সরকার স্থগিত করেছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে আমরা বিষয়টি নিয়ে আর আগ্রহ দেখাচ্ছি না।’ এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে তারা চিঠি দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার এখন সিদ্ধান্ত নেবে।’
গ্যাস পরিবহনের জন্য সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ৯৯ কিলোমিটার পাইপলাইনের মধ্যে ভারতীয় অংশে ৪৭ কিলোমিটার এবং বাংলাদেশ অংশে ৫২ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কথা ছিল। দৈনিক ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন এই পাইপলাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে প্রাথমিকভাবে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে দৈনিক ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
সমঝোতা চুক্তির আওতায় এইচ-এনার্জি থেকে বছরে শূন্য দশমিক ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে খুলনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে এবং দেশের পশ্চিমাঞ্চলে প্রথমবারের মতো গ্যাস সরবরাহ করারও পরিকল্পনা ছিল সরকারের। এই গ্যাসের ওপর নির্ভর করেই খুলনায় ‘রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র’ নির্মাণ করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। কেন্দ্রটির কাজ শেষ হলেও গ্যাসের অভাবে এখন উৎপাদনে যেতে পারছে না।
সূত্রমতে, ভারত তাদের মহারাষ্ট্রের জয়গড় সমুদ্রবন্দরে অবস্থিত এলএনজি টার্মিনাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত যে পাইপলাইন স্থাপনের কাজ করছে মূলত সেটার সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছে বাংলাদেশ। যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে ভারত তাদের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করতে আগ্রহী। একই সঙ্গে এ পাইপলাইন থেকে বাংলাদেশও গ্যাস পেতে চেয়েছিল।
শুধু এলএনজি আমদানিই নয়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চেষ্টা করেছিল ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপলাইনে (মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত) যুক্ত হতে। শেষ পর্যন্ত পারেনি।
বর্তমানে ভারত থেকে ২ হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ। যার মধ্যে আদানি থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। আদানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা না করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সুবিধা বেশি দেওয়া হচ্ছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যুতের পাশাপাশি দুদেশের মধ্যে জ্বালানি তেলের পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে ডিজেলও আমদানি হচ্ছে। সর্বশেষ চেষ্টা ছিল পাইপলাইনের মাধ্যমে এলএনজি আমদানির। এর ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারতের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। এতে বাংলাদেশের নানা রকম ক্ষতিরও সুযোগ তৈরি হয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভারত থেকে গ্যাস আমদানির প্রকল্পটি বিশেষ আইনে হওয়ায় এটি বাতিল করা যৌক্তিক। তা ছাড়া ভারত আমদানিকৃত উচ্চমূল্যের গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কোনো গুরুত্ব দেখছি না।’
তবে গ্যাস দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেজন্য দেশের অভ্যন্তরে অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি এলএনজি আমদানি করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা হতে হবে তুলনামূলক সাশ্রয়ী। ভারত থেকে গ্যাস আমদানি যদি সাশ্রয়ী হয় এবং তাতে যদি দেশের স্বার্থ রক্ষা পায় তাহলে বিশেষ আইনের আওতায় করা আগের চুক্তি বাতিল করে নতুন করে চুক্তি করা যেতে পারে।’
অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘বিপ্লবী সরকার’ ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে রিটঅন্তর্বর্তী সরকারকে ‘বিপ্লবী সরকার’ ঘোষণার নির্দেশনা চেয়ে রিট
প্রতিবেশী দেশের ওপর কিছুটা নির্ভরশীলতা থাকা ভালো মন্তব্য করে ইজাজ হোসেন বলেন, ‘কিন্তু বিদ্যুৎ-জ্বালানির মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ খাতে অতিমাত্রায় যাতে আমরা নির্ভরশীল না হয়ে পড়ি, সে বিষয়ে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।’
বাংলাদেশে আমদানি করা এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তর ও সরবরাহ করার জন্য ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর ভারতীয় কোম্পানি এইচ এনার্জির প্রস্তাব অনুমোদন করে সরকার। তখন পাইপলাইন নির্মাণ করার প্রস্তাব না থাকলেও নতুন করে বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহের পাশাপাশি পাইপলাইনও নির্মাণ করতে চেয়েছিল এইচ এনার্জি। আর কোম্পানিটি পাইপলাইন নির্মাণের দাবিতে অনড় থাকায় ভারত থেকে গ্যাস আমদানির প্রকল্প আটকে যায়।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস সঞ্চালনের পাইপলাইন নির্মাণ করে থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)।
বিদায়বেলায় সঙ্গী শুধুই কাটার জ্বালা বিদায়বেলায় সঙ্গী শুধুই কাটার জ্বালা
দেশের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস অনুসন্ধানে অবহেলার কারণে গ্যাসের মজুদ যেমন কমছে তেমনি চাহিদাও বাড়ছে দিনে দিনে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর মধ্যে আমদানি করা হচ্ছে প্রায় ৯২৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
সংকট সামাল দিতে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে সরকারকে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ছয় কার্গো এলএনজি আমদানি করার কথা থাকলেও আমদানি করা হয়েছে তিন কার্গো। এ ছাড়া চলতি মাসে পাঁচ কার্গো, নভেম্বরে পাঁচ কার্গো এবং বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে চার কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে পেট্রোবাংলা।