Rauful Alam
Writer and Member : American chemistry society
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশী অনেক ভালো ভালো গবেষক এবং বিজ্ঞানী এখন দেশে ও দেশের বাহিরে কাজ করেন। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে অসম্ভব ট্যালেন্টেড একটা দল সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।
আমি তাদের কাছে অনুরোধ করবো, তারা যেনো নিজেদের গবেষণা কাজের পাশাপাশি, ব্যস্ততার পাশাপাশি, সমাজের ভুয়া বিজ্ঞান, ভুয়া দাবি, ভুয়া গবেষণা, সুডো-সাইন্স এসব নিয়ে কথা বলেন। কিংবা প্রতিবাদ করেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এটা না করলে, সমাজে মিথ্যা ও ভুয়া-বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয় দ্রুত। বিজ্ঞানের আসল উদ্দেশ্যটাই তরুণদের মধ্যে অজানা থেকে যায়। ইনোভেশনের সঠিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয় না।
অনেকেই এগুলো নিয়ে কথা বলেন না বা এড়িয়ে যান—কারণ প্যারা নিতে চায় না। কিন্তু এটাও সত্য, বিজ্ঞান চর্চার যে মৌলিক বিষয়গুলো আছে, সেগুলো সমাজের তরুণদেরকে বুঝানো, তাদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া, যে কোন গবেষকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। উন্নত সমাজে শত বছর ধরে জ্ঞান-গবেষণার সংস্কৃতি থাকার পরও অনেক বড়ো বড়ো গবেষক সমাজের তরুণদেরকে সচেতনতায় কাজ করেন।
আমেরিকান প্যাটেন্ট নিয়ে আমি পড়েছি। পণ্ডিত না হলেও আলাপ চালিযে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো জানি। পাণ্ডিত্য দাবি করতে হলে, USPTO লাইসেন্স নিতে হবে। এবং এই লাইসেন্স পরীক্ষা খুবই কঠিন। তাই এখনো সাহস পাইনি। World Intelectual Property Organization (WIPO)-র নিয়ম-কানুন নিয়ে পড়েছি। আমি নিজে আন্তর্জাতিক ৯ টা প্যাটেন্ট এপলিকেশনের কো-ইনভেন্টর (Co-inventor)। আর দুইটা গ্রেন্টেড প্যান্টেন্টের (আমেরিকায়) কো-ইনভেন্টর। (প্যাটেন্ট নিয়ে একসময় বিস্তর লিখবো)
কোনটাকে উদ্ভাবন বলে, কোনটাকে আবিষ্কার বলে, কোনটা উদ্ভাবন হওয়ার যোগ্য বা যোগ্য না—এই বিষয়গুলো আমাদের তরুণদের জানাতে হবে। আমি দূর থেকে যতটুকু সম্ভব লক্ষ্য করে দেখেছি, দেশের অনেক পদাধারী লোকরাও “সুডো-গবেষণাকে” কি নির্বিকার “উদ্ভাবন” “আবিষ্কার” বলে মানুষকে বোকা বানায়। এমনকি রাষ্ট্রকে। মিডিয়াতে নিজের বড়ো আবিষ্কার বলে ফলাও করে। এসব কাজ করতে গিয়ে তাদের একটু ভাবা দরকার। সময়টা কিন্তু এখন ১৯৭০-৮০ সাল না।
বিশ বছর আগে পাওয়া যায়, এমন ইউটিউব ভিডিওর কাজকে নিজের আবিষ্কার বলে সংবাদ মাধ্যমেও প্রচার করছে। অথচ কোন কিছুকে উদ্ভাবন দাবি করা যাবে কিনা, সেটার অন্যতম শর্ত হলো “প্রায়োর আর্ট (Prior Art)”। অর্থাৎ পাবলিক ডোমেইনে যথারীতি আছে ( পাবলিকেশন, আর্টিকেল, ম্যাগাজিন, ইউটিউব ভিডিও, প্যাটেন্ট ইত্যাদি) তেমন কাজ আপনি যদি পূণরায় করেন (recreate), সেটা উদ্ভাবন না। আপনার সে উদ্ভাবন কখনোই গ্র্যান্টেড হবে না।
আগে কোন কিছু করা হয়ে গেলে, সেটা নভেলটিকে (Novelty) ধ্বংস করে। এজন্যই নাজমুলের হেলিকপ্টর কোনদিনই “আবিষ্কার বা উদ্ভাবন” কোনটাই হবে না। সেটা হবে শেখা বা বিনোদনের জন্য পূণরায় তৈরি (Recreate)। উদাহরণ সরূপ, নাজমুল যদি সূর্যের আলো দিয়ে হেলিকপ্টর চালাতে পারে, তাহলে সেটা হবে উদ্ভাবন (এটা আবিষ্কার না)। কারণ সে এমন একটা নতুন কিছু যুক্ত করেছে, যেটা স্বাভাবিক বা সাধারণ না। বা সেটার অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বৈশ্বিক প্যাটেন্ট নিয়মে এটাকে বলে “Non-obviousness”।
নাজমুল না হয় পড়াশুনা করেনি। Prior Art, Novelty, Non-obviousness এসব জানে না। মৌলিক গবেষণা, আবিষ্কার, উদ্ভাবন এগুলো বুঝে না। আপনারা যারা উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন দাবি করেন, তারা কেন মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন?
দেশে বিদেশে আমাদের যেসব গবেষকরা আছেন, তারা যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে না বলি, না লিখি, ধরিয়ে না দেই—তাহলে সত্যিকারে গবেষণার সংষ্কৃতি তৈরি করা যাবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান কি করেছে জানেন? জাপান তাদের সবচেয়ে বেশি তরুণকে আমেরিকা পাঠিয়েছে।
জাপান চিন্তা করলো, যে আমেরিকা হিরোশিমা ও নাগাসাকি ধ্বংস করে দিয়েছে, সেই আমেরিকা থেকেই শিখতে হবে। জানতে হবে, আমেরিকার কি আছে, যেটা আমাদের নাই।
জাপানের তরুণরা আমেরিকা গিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করলো। আমেরিকার সেরা সেরা ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করলো। মাথার মধ্যে সবকিছু স্ক্যান করে জাপান ফিরে গেলো। জাপান সরকার সেইসব তরুণদের পেছনে প্রচুর টাকা ঢেলে দিলো। জাপানিজ তরুণরা রাজনীতি বুঝে না। মন্ত্রী চিনে না। দিন-রাত একাকার করে কাজ করে যায়।
সেই জাপান আজ পৃথিবীর একটা পরাশক্তি। পৃথিবীর সুন্দরতম দেশগুলোর একটা। তারা যোগ্য মানুষ দিয়ে ব্যবস্থাপনা দাঁড় করিয়েছে। নিজেদের মধ্যে দিনভর গুতাগুতি করে না।
আজকে আমি যদি লিখি, “পাঁচ লক্ষ লোক নিয়ে দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা দিবো, দিল্লী ঘেরাও করবো”। এটা একটা পপুলিস্ট পোস্ট হবে। আপনি লাইক করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দশ লক্ষ মানুষ নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদ করেও ভারতের সাথে আমি দাঁড়াতে পারবো না। ভারত সরকারকে ভয় দেখাতে পারবো না।
আমাদের তাইলে কি করতে হবে?
বাংলাদেশ সরকার, ভারত সরকারকে কূটনৈতিকভাবে সামাল দিতে হবে। এই সামাল দেয়ার জন্যও চাই যোগ্য নেতা। সাহসী নেতা। ভারতের সাথে আমদানি-রফতানির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ভারতের সাথে চুক্তি হলে, সেই চুক্তির বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে সহস্র ছেলে-মেয়েদেরকে ভারতের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ দেয়ার শর্ত দিতে হবে।
ভারত ২৩ টা বিশ্বমানের আইআইটি গড়ে তুলতে পেরেছে। আমরা আজো সে মানের একটা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলতে পারিনি। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজো কেন আইআইটির মানে হলো না—সেটার জন্য আমাদের সরকারকে চাপ দিতে হবে। যদি ১০০০ কোটি টাকা খরচ করেও সেই মানের প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে হয়, তাহলে সেটা করতে হবে। সারা দুনিয়া থেকে আমরা শিখবো। সারা দুনিয়াতে আমাদের ব্রিলিয়ান্ট তরুণদেরকে পাঠাবো। বাংলাদেশের সামরিক গবেষণাকে শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশের সামরিক গবেষণা বলতে গেলে শূণ্য! তরুণদের ভিতর এখন যে শক্তিটা আছে, সেটাকে এইসব পজেটিভ কাজে ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া কোন মুক্তি নাই।
বাংলাদেশে যদি বিশ্বমানের ৫০০ বিজ্ঞানীও থাকে—ভারত সরকার বাংলাদেশকে সমীহ করতে বাধ্য। কথাটা আপনি লিখে রাখুন।
প্রতিবেশীর সাথে শিক্ষা, গবেষণা ও সামরিক শক্তিতে সমশক্তির হতে না পারলে, প্রতিবেশীর সাথে শুধু রক্ত দিয়ে টিকে থাকা যায় না। এটাই পৃথিবীর জাতীয়তাবাদের শিক্ষা। আপনি তো প্রতিবেশী বদলাতে পারবেন না। আমি উগ্রজাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী না। আবার শোষণের শিকারও হতে চাই না। আমি চাই সম আদান-প্রদানের বন্ধুত্ব।
রসায়নের ভাষায় সমযোজী বন্ধন।
একটা দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য লাগে টেকসই পরিকল্পনা।
এ জন্যই “একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায়” লিখেছিলাম।
রাষ্ট্রকে শক্তভাবে দাঁড় করানোর উপায় হলো শক্ত শিক্ষা। তারুণ্যকে প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যস্ত রাখা।
যোগ্যতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। তীব্র প্রতিযোগিতা আর শুধুমাত্র যোগ্যতার বিবেচনায় নিয়োগের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্বমানের শিক্ষক গড়ায় প্রতিনিয়ত ফোকাস দেয়া। কারণ শিক্ষকরা হলেন সমাজের কারিগরদের কারিগর।
দেশের বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষনাগার এগুলো থেকে রাজনৈতিক পূজার সংস্কৃতি চিরতরে দূর করা।
যেসব নিয়ম রাষ্ট্রকে আগাতে দেয় না, সেগুলোকে ধ্বংস করা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দাসত্বের ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা। কারণ নেতার দাসত্বে যে সমাজের তরুণরা আটকে যায়, সে সমাজের মুক্তি নাই। সময়ে সময়ে তরুণদের জন্য শক্তিশালী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থ করা। সরকারী-বেসরকারী সব জায়গায় শক্ত জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা।
ইউরোপ এগুলো করেই দাঁড়িয়েছে। জাপান দাঁড়িয়েছে। দক্ষিন কোরিয়া, চীন, আরব আমিরাত, সৌদি আরব এভাবেই দাঁড়িয়েছে। এগুলোর চর্চা করেই অন্যান্য দেশকে দাঁড়াতে হবে। এগুলোই চিরন্তন।
চীন আমেরিকাকে কিভাবে জবাব দেয়?
আমেরিকার “ফেইসবুক” চীন ব্যবহার করে না। চীন সেটাকে ব্যান করে রেখেছে। তবে বিকল্প একটা তৈরি করেছে।
আমেরিকার গুগল ওরা ব্যবহার করে না। গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে না। চীন নিজেরাই বিকল্প এপ তৈরি করেছে—বাইডু! WeChat নামক জনপ্রিয় এক এপ দিয়ে চীনের মানুষ বহু কাজ করে ফেলে।
আমেরিকান পণ্য ব্যবহার করে, আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্ত করতে চীন রাজি না। কিন্তু চীনের পণ্য সারা পৃথিবীতে ওরা ছড়িয়ে দিবে। পণ্য আর মানুষ—এই দুই জিনিস চীন সারা দুনিয়াতে দিয়ে দিয়েছে।
এদিকে চীন, আমেরিকা থেকে প্রফেসর নিয়ে যায়। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে নিয়ে যায়। আর সারা দুনিয়া থেকে ছেঁকে ছেঁকে নিয়ে যায় চাইনিজ ব্রিলিয়ান্টদের। এই ছাঁকা পরীক্ষায় যারা ঢুকতে পারে না, তারা অন্য দেশে পড়ে থাকলেও, চীন সেটা নিয়ে মাথাও ঘামায় না। You stand with the best, you get into the best! এটাই হলো ওদের প্রিন্সিপাল।
যে জাপানর সাথে তাদের রাজনৈতিক চির শত্রুতা, সেই জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যন্ত, চীনের ছেলে-মেয়েরা ভরা।
অথচ বাংলাদেশের কয়েক লক্ষ রোগী প্রতিবছর শুধু বিদেশে যায় চিকিৎসা নিতে। দেশের টাকা ঢেলে দেয় বিদেশে গিয়ে। দেশে সে মানের চিকিৎসা সেবা পায় না বলে অভিযোগ-আক্ষেপ। দেশের পয়সাওয়ালারা ছেলে-মেয়েদেরকে টাকা দিয়ে বিদেশে পড়ায়। অথচ ৫৩ বছরেও একটা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের হয়ে উঠে না।
রাজনীতিবিদরা, চাকরিজীবিরা দুর্নীতি করে বাড়ি কিনে বিদেশে। শিল্পপতিরা শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে চায় না, কিন্তু কানাডা, সিঙ্গাপুর টাকা জমায়। রাজনীতিবিদরা লুট-পাট করে ক্ষমতা শেষ হলে বিদেশে বসে দেশ নিয়ে চক্রান্ত করে। মিথ্যা ছড়ায়।
দেশের বহু ব্রিলিয়ান্ট ছেলে-মেয়ে দেশ ছাড়ে। দেশে ফিরতে পারে না। ফেরার পথগুলো সব বন্ধ করে রাখা হয়েছে যতোসব পুরোনো নিয়ম-নীতি দিয়ে।
কিন্তু আমেরিকার ফেইসবুক, ইউটিউব ব্যবহার করে, আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্ত করছি আমরা। জাপানের গাড়ি কিনছি। ভারতের ডাক্তারদের ধনী করছি। চীনের ইঞ্জিনিয়ারদের পয়সা দিচ্ছি। আমাদের কর্পোরেট চাকরি করছে চীন-ভারত-শ্রীলংকার লোকজন। এদিকে ভূ-মধ্যসাগরে আমাদের তরুণরা নৌকাডুবিতে মরে।
আমরা তো সবদিকে শুধু হারাই। পাই কি? আমাদের দরকার এমন পরিকল্পনা ও নীতি, যেখানে দেশটা সবদিক দিয়ে গেইন করবে বেশি। লুজ করবে কম। দাঁড়াতে হলে নেট গেইন বাড়াতে হবে—সর্বক্ষেত্রে। সেভাবেই দিতে হবে বিশ্বকে জবাব!
তরুণদেরকে যতো প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যাস্ত রাখার ব্যবস্থা তৈরি করবেন, দেশ ততো শান্ত থাকবে। এটাই নিয়ম।
শক্ত পড়াশুনা দেন। পাশ করার কঠিন ব্যবস্থা করেন। ভালো প্রশিক্ষণ দেন। জনশক্তি রফতানির ব্যবস্থা সহজ করে দেন। কর্মসংস্হান তৈরি করুন। তরুণদের ন্যাশনাল ডেইটাবেইজ তৈরি করেন। যারা সমাজে অনিয়ম করবে তারা সমাজ থেকে যেনো কোন সুবিধা না পায়—এমন ভয় তৈরি না করলে অপকর্ম করেই যাবে
দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থায় এদের একটা বড়ো অংশ বামন-বুদ্ধির হয়ে উঠেছে। এরাই ধমার্ন্ধ হচ্ছে। নাইলে সহ-সভাপতি হচ্ছে। নাইলে দলান্ধ হচ্ছে। নেতার দাস হচ্ছে। সমাজে সমস্যা তৈরি করা ছাড়া ভালো কিছু ওরা কি করে করবে?
nice