অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড় মানেই ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গমুখী

0
4

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের মাঝ দিয়ে অতিক্রান্ত হবে পূর্বাভাসেই তা বলা হয়েছিল। পূর্বাভাস অনুযায়ী নির্ধারিত গতিতেই তা আঘাত হেনেছে। সাধারণত ঘূর্ণিঝড় উপকূলের কাছাকাছি এলে ডানে বা বামে বাঁক নেয়। কিন্তু ‘দানা’ অনুমান মোতাবেক উপকূল অতিক্রম করেছে। কিন্তু কেন?

একাধিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ বলেছেন, অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরে যে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় সেসবের বেশিরভাগের গন্তব্য হয় ভারতের ওড়িশা কিংবা পশ্চিমবঙ্গ উপকূল। কখনো কখনো তা তামিলনাড়ু– উপকূলের দিকেও যায়। বাংলাদেশ উপকূলের দিকে আসার সম্ভাবনা কম থাকে।

https://a0af3f4e736ad69c51d7eba65ec247b2.safeframe.googlesyndication.com/safeframe/1-0-40/html/container.html

আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপাত্তে দেখা গেছে, ১৮৯১ সাল থেকে গত বৃহস্পতিবারের ‘দানা’ পর্যন্ত ১৩৪ বছরে বঙ্গোপসাগরে অক্টোবর মাসে ৯৫টি ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোর ৭৬টি ঘূর্ণিঝড়ের গন্তব্য হয়েছে ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূল, বাকি ১৯টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত করেছে। এই ১৯টি ঘূর্ণিঝড়ের প্রায় সবগুলোর গন্তব্য ছিল দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা।

https://a0af3f4e736ad69c51d7eba65ec247b2.safeframe.googlesyndication.com/safeframe/1-0-40/html/container.html

শুধু অক্টোবর নয়, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের ঘূর্ণিঝড়গুলোর বেশিরভাগের গন্তব্য দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল। ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় গিয়েছিল ভোলার উপর দিয়ে। ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বরের ‘সিডর’ আঘাত করেছিল বরগুনার উপর দিয়ে। ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ আঘাত করেছিল ভোলায়। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আঘাত করেছিল খুলনায়। ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবরের ‘তিতলি’ আবার ওড়িশার ভুবনেশ্বরে আঘাত করেছিল।

https://a0af3f4e736ad69c51d7eba65ec247b2.safeframe.googlesyndication.com/safeframe/1-0-40/html/container.html

ঘূর্ণিঝড় নিয়ে গত ২৭ বছর ধরে কাজ করছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ কামরুল হাসান। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড়গুলো বেশিরভাগ সময়ই ভারতমুখী হয়ে থাকে। তবে অক্টোবরের শেষ কিংবা নভেম্বর বা আরও পরে উৎপত্তি হওয়া ঝড়গুলো ডান দিকে বাঁক নিয়ে বাংলাদেশ অভিমুখী হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলে আঘাত করে থাকে।’

https://a0af3f4e736ad69c51d7eba65ec247b2.safeframe.googlesyndication.com/safeframe/1-0-40/html/container.html

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের দিক নির্ভর করে ভূ-পৃষ্ঠের ৩০ থেকে ৪০ হাজার ফুট উপরে থাকা উল্টো ঘূর্ণিঝড়ের উপর। উল্টো ঘূর্ণিঝড়ই দেখিয়ে দেয় সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টি কোন দিকে বাঁক নিবে। ‘দানা’র ক্ষেত্রে দেখা যায়, উল্টো ঘূর্ণিঝড় স্থির ছিল। সেটি স্থির থাকার কারণেই সাগরের ঝড়টি তার নির্ধারিত গতিপথে এগিয়ে গেছে। কোনো বাঁক নেয়নি।’

তিনি বলেন, ‘যদি দানা নামের ঝড়টি নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হতো তাহলে হয়তো তা আরেকটু ডান দিকে বাঁক নিতো। তখন আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল বা দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত করতো।’

ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, ‘অক্টোবরের ঝড়গুলোর গতিপথ ভারতের দিকেই বেশি হয়ে থাকে। সময়ে সময়ে তা ডান দিকে বাঁক নিয়ে থাকে।’

অক্টোবরের ঝড়গুলোর বাংলাদেশ উপকূলের দিকে কম আসার আরেকটি কারণ হলো মৌসুমী বায়ুর বিদায়। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘মৌসুমী বায়ু বিদায় নিয়ে থাকে অক্টোবরের মাঝামাঝি। এর প্রভাব সাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের উপর থাকে। ফলে মৌসুমী বায়ু বিদায়ের পরপর ঘূর্ণিঝড়গুলো আমাদের উপকূলের দিকে আসে না। তবে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যেগুলো সৃষ্টি হবে সেগুলোর বাংলাদেশ উপকূলে আসার সম্ভাবনা থাকে।’

ঘূর্ণিঝড়ের পরিসংখ্যানও তাই বলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৮৯১ থেকে এ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে ৯৫টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। এর ১৯টি বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত করেছে। বাকি ৭৬টি ভারতীয় উপকূলে।’

‘দানা’র গতি ছিল ১২০ কিলোমিটার

গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টার পর ওড়িশার উপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ উপকূল অতিক্রম শুরু করে। ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে আঘাত করা ‘দানা’র প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ওড়িশায়। পশ্চিমবঙ্গেও ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। তবে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের গতিবেগ কমে আসে বলে জানা গেছে।

ঝড়ের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ফোরকাস্টিং কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক শুক্রবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ ছিল ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে। তাই বাংলাদেশ উপকূলে এর প্রভাব তেমন দেখা যায়নি। তবে গত বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে উত্তর বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়টি থাকার সময় হঠাৎ করে একটি অংশ বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় আর এর প্রভাবে ভোলা ও পটুয়াখালী এলাকায় ঝড়ো বাতাস প্রবাহিত হয়েছিল।’

গত সোমবার বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। লঘুচাপটি গত মঙ্গলবার সকালে নিম্নচাপে রূপ নেওয়ার পর একই দিন রাতে গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়। বুধবার ৬টায় গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘দানা’। এর প্রভাবে সাগর উত্তাল ছিল বলে দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে তিন নম্বর স্থানীয় সর্তকতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর।

উল্লেখ্য, বঙ্গোপসাগরে প্রাক-বর্ষা মৌসুম (এপ্রিল-মে) ও বর্ষা-উত্তর মৌসুমে (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। চলতি মাসের আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে এক থেকে তিনটি লঘুচাপ বা নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এদের একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে এ কথাও বলা হয়েছিল। ইতিমধ্যে একটি নিম্নচাপ ভারতের তামিলনাড়– উপকূল দিয়ে অতিক্রম করেছে, সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ পশ্চিমবঙ্গে আঘাত করলো। 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে